দুর্গম পাহাড়ের ঝরনাধারা কঠিন ও কমনীয়তার এক অকৃত্রিম মেলবন্ধন। এমন নৈসর্গিক দর্শন নিমেষেই ভোলাতে পারে যে কারো মন। বান্দরবানের নাফাখুম জলপ্রপাত বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলপ্রপাতগুলোর তালিকায় নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছে। আজকের প্রবন্ধটি এই নাফাখুমকে নিয়েই। চলুন, দেখে নেওয়া যাক কতটুকু রোমাঞ্চের পর দেখা পাওয়া যায় এই অমিয়ধারার।
নাফাখুম ঝরনার নামকরণ
এই ঝরনার নামকরণের কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হবে রেমাক্রি নদীর কথা। এই নদীতে নাফা নামে এক ধরনের মাছ আছে, যেটি সবসময় স্রোতের বিপরীত দিকে চলে। এভাবে চলতে গিয়ে মাছগুলো লাফিয়ে ঝরনা পার হওয়ার সময় এদের কাপড় বা জালে আটকে ফেলে স্থানীয় আদিবাসীরা।
এই আদিবাসীদের বসতবাড়িগুলো দেখা যায় সবুজে ঘেরা পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। পাহাড়ের ঢালে টিন আর বেড়া দেওয়া ঘরগুলোকে মারমা ভাষায় ‘খুম’ বলা হয়, যার অর্থ জলপ্রপাত। আর এভাবেই নাফা আর খুম শব্দ দুটি মিলে ঝরনার নাম হয়েছে নাফাখুম।
নাফাখুম জলপ্রপাতের অবস্থান
জলপ্রপাতের জায়গাটি পড়েছে বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে। থানচি বান্দরবান সদর থেকে প্রায় ৭৯ কিলোমিটার দূরে।
থানচি বাজারের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে সাঙ্গু নদী, যেটি রেমাক্রি থেকে থানচির দিকে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে গেছে। নদীপথে কিছুদূর পর পর ১ থেকে ২ ফুট, এমনকি কোনো কোনো জায়গায় ৪ থেকে ৫ ফুট পর্যন্তও ঢালু। এই পথে নৌকা বেয়ে ওপরে উঠার সময় দুপাশের সবুজে মোড়ানো উঁচু পাহাড়গুলো চোখে পড়ে। এগুলোর কোনো কোনোটা এতটাই উঁচু যে, দেখে মনে হয় সেগুলোর চূড়া হারিয়ে গেছে মেঘের ওপরে।
ওপরে রেমাক্রি মূলত একটি মারমা অধ্যুষিত এলাকা। সেখান থেকে তিন ঘণ্টা হেঁটে গেলেই পাওয়া যায় জলপ্রপাতের দর্শন।
নাফাখুম ঝরনা দেখার সঠিক সময়
এখানে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় থাকে। তবে বর্ষার বৃষ্টিতে অধিকাংশ সময় সাঙ্গু নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে চলে আসে। তাই প্রশাসন থেকেই নাফাখুম ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
নাফাখুম বেড়ানোর উপযুক্ত সময় বর্ষার ঠিক পর থেকে শীতকালের আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের যে কোনো সময়কে বেছে নেওয়া যেতে পারে। একদম কনকনে শীতের সময় ঝরনার পানি সব শুকিয়ে যায়। কিন্তু তাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতে কোনো ঘাটতি পড়ে না।
নাফাখুম ভ্রমণে যা দেখতে পাবেন
রেমাক্রি খালের পানি নাফাখুমে এসে বাঁক নিয়ে নেমে গেছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ফুট নিচে। আর এতেই জন্ম নিয়েছে প্রাকৃতিক এই জলপ্রপাত। প্রচণ্ড গতির জলীয় বাষ্পে প্রায়ই সূর্যের আলোয় ঝলমল করে ওঠে রংধনু। এছাড়াও ভীষণভাবে আছড়ে পড়া পানি ঝরনার চারদিকে সৃষ্টি করে ঘন কুয়াশা। উড়ে যাওয়া বা ছিটকে পড়া পানি বাষ্পে ভেসে এসে শরীরে স্পর্শ করে। ঠিক কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মেতো। আর এই কারণেই নাফাখুমকে বাংলার নায়াগ্রা বলা হয়ে থাকে।
এই ভ্রমণের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা যাবে নীলগিরি, চিম্বুক, সাঙ্গু নদী, মিলনছড়ি, পদ্মমুখ, রেমাক্রি ঝর্ণা, তিন্দু, বিজিবি ক্যাম্প, বড় বা রাজাপাথর ও মারমা পাড়া।
ঢাকা থেকে নাফাখুম যাওয়ার উপায়
ঢাকার গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে বিভিন্ন ধরনের বাস বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এগুলোর মধ্যে নন-এসিগুলোর ভাড়া জনপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। আর এসিগুলো জনপ্রতি ১০০০ থেকে ১৬০০ টাকা ভাড়া নেয়।
ট্রেনে যেতে হলে ঢাকা থেকে প্রথমে চট্টগ্রাম যেতে হবে। শ্রেণিভেদে ট্রেনের ভাড়া পড়বে ৩৪৫ থেকে শুরু করে ১২২৯ টাকা পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম পৌঁছে বহদ্দারহাট বাস স্টেশন থেকে বান্দরবানের বাস ধরতে হবে। বাস ভাড়া জনপ্রতি ২২০ টাকা করে নিতে পারে। এ ছাড়া দামপাড়া বাস স্টেশন থেকেও বান্দরবানের বাস ছাড়ে।
চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি রিজার্ভ নিয়েও বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা হওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে গুনতে হবে ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা।
বান্দরবান থেকে থানচি
বান্দরবান থেকে বাসে কিংবা জিপ রিজার্ভ নিয়ে থানচি যাওয়া যায়। বান্দরবানের থানচি বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় থানচিগামী লোকাল বাস পাওয়া যায়। এগুলোতে বাস ভাড়া মাথাপিছু ২০০ টাকা, আর সময় লাগতে পারে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মতো।
জিপ রিজার্ভ নিয়ে অথবা চাঁন্দের গাড়ি নিলে খরচ পড়বে ৫৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা। এখানে সময় লাগতে পারে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। এক গাড়িতে সহজেই ১২ থেকে ১৪ জনের জায়গা হয়।
থানচি থেকে রেমাক্রি
থানচি আসার পর একজন গাইড ঠিক করতে হবে এবং এটা আবশ্যিক। দল বড়-ছোট যাই হোক না কেন, গাইড ছাড়া নাফাখুম যাওয়া যায় না।
এখানে উপজেলা প্রসাশন কর্তৃক প্রত্যয়িত গাইড পাওয়া যায়। প্রথম দিন ঘুরে পরের দিন থানচি ফিরে আসা পর্যন্ত গাইড ফি ১৫০০ টাকা।
গাইড ঠিক করার পর কাজ হচ্ছে থানচি বিজিবি ক্যাম্প বা থানা থেকে অনুমতি নেওয়া। গ্রুপের সবার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, কোথায় যাবে, কয়দিন থাকবে সবকিছু কাগজে লিখে ক্যাম্পে জমা দিতে হবে। এই অনুমতি নেওয়ার কাজে গাইড সম্পূর্ণ সহায়তা করবে।
আর মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, বিকাল ৩ টার পর থানচি থেকে আর রেমাক্রি যাবার অনুমতি দেওয়া হয় না। তাই অবশ্যই ২টার মধ্যে থানচি থাকা জরুরি। অন্যথায় ওইদিন থানচি থেকে পরের দিন সকালে রেমাক্রির উদ্দেশে রওনা হতে হবে।
অনুমতি পাওয়ার পর এবার থানচি ঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করার পালা। ৪ থেকে ৫ জন ধরে এমন নৌকার ভাড়া ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা। এই ভাড়ায় রেমাক্রি পর্যন্ত যেয়ে পরদিন আসা যাবে, যেখানে সময় লাগবে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।
সাঙ্গুতে পানি কম থাকলে কিছু কিছু জায়গায় নৌকা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করতে হয়। এই যাত্রাপথে সাঙ্গু নদীর রূপ ছাড়াও বিমোহিত করবে পদ্মমুখ, ভূ-স্বর্গ খ্যাত তিন্দু, রাজাপাথর বড়পাথর এলাকা ও রেমাক্রি ঝর্ণা।
রেমাক্রি থেকে নাফাখুম
খুব সকালে বান্দরবান থেকে রওনা দিলেও রেমাক্রি পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যায়। তাই সেই দিন রাতে রেমাক্রি বাজার থেকে পরের দিন সকালে নাফাখুম যাত্রা শুরু করতে হয়।
এবার রেমাক্রি থেকে স্থানীয় আরও একজন গাইড ঠিক করতে হবে। এই গাইডের জন্য ৫০০ টাকা খরচ করা লাগবে। অবশ্য থানচি থেকে আসা আগের গাইডই এই নতুন গাইডকে ঠিক করে দিবে। রেমাক্রি খাল ধরে হেঁটে রেমাক্রি থেকে নাফাখুম যেতে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে।
নাফাখুমে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
থানচিতে ভালো কোথাও থাকার একমাত্র উপায় বিজিবি নিয়ন্ত্রিত সীমান্ত অবকাশ কেন্দ্র। এখানে ১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা এর মধ্যে রুম ভাড়া পাওয়া যায়। থানচি বাজারের আশেপাশের কটেজ ও হোটেলগুলোতে মান অনুযায়ী দিন প্রতি ভাড়া ২০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।
এ ছাড়া রেমাক্রি বাজারে আদিবাসীদের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাঙ্গু নদীর পাশে আদিবাসীদের রেস্ট হাউজে থাকার জন্য ভাড়া লাগতে পারে মাথাপিছু ১৫০ টাকা।
খাবারের বেলায়ও থানচি বাজারের হোটেলগুলোই ভালো। স্থানীয়দের বাড়িতে থাকার ক্ষেত্রে খাবারের জন্য গাইডকে দিয়ে তাদেরকে আগে থেকে জানিয়ে রাখা যেতে পারে। এখানে সাধারণত ভাত-ভর্তা, ভাজি ও ডিমের জন্য ৮০ টাকা, আর মুরগি যোগ হলে খরচ পড়বে ১২০ টাকা।
নাফাখুম জলপ্রপাত ভ্রমণ টিপ্স ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা
বর্ষার সময় গেলে লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নেওয়া আবশ্যক। পাহাড় ট্রেকিংয়ের জন্য ভালো গ্রিপের জুতা নিতে হবে। সেইসঙ্গে বাঁশের লাঠিও সঙ্গে রাখতে হবে। এরপরেও হাঁটার সময় যথেষ্ট সাবধান থাকতে হবে। জলপ্রপাতের নিচের জলাশয় বেশ গভীর এবং তাতে পাথরও আছে। তাই ওপর থেকে লাফ দেওয়াটা একদমই উচিত হবে না।
থানচির পর বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক একদমই কাজ করে না। তাই আগে থেকেই ক্যামেরা ও মোবাইল ১০০ ভাগ চার্জ দিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে সঙ্গে পাওয়ার ব্যাংক রাখা ভালো। এ ধরনের ভ্রমণে সঙ্গে অবশ্যই ফার্স্ট এইড কিট বক্স এবং বিশুদ্ধ খাবার পানি রাখা উচিত। স্থানীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলার জন্য সময়ের দিকে সবসময় খেয়াল রাখা জরুরি। একা একা রাস্তা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন, তাই কোনোভাবে দলচ্যুত হওয়া যাবে না। ছোট বাচ্চা, অসুস্থ ও বয়স্কদের এই ধরনের ভ্রমণে যাওয়া উচিত নয়। এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে পরিবেশ, প্রকৃতি ও স্থানীয় মানুষদের ক্ষতি হয়। ময়লা-আবর্জনা নির্ধারিত জায়গা মত ফেলতে হবে। কোনো জায়গা না পাওয়া গেলে সব একসঙ্গে করে পুড়িয়ে দিতে হবে। ঝিরি বা পাহাড়ি পথ অনেক ক্লান্তিকর। তাই ব্যাকপ্যাক যত হালকা হয় ততই ভালো।
পরিশিষ্ট
পাহাড় ট্রেকিংয়ে উৎসাহী যে কোনো অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীই বান্দরবানের নাফাখুম জলপ্রপাত একবার দেখার পর আবার সেখানে ফিরে যেতে চাইবেন। গহীন অরণ্য, আদিবাসীদের জীবনচরিত, সাঙ্গুর ভয়ংকর রূপ বা শীতের টলমলে পাথুরে পানির খেলা কোনো ভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়।
যারা ঝটিকা সফর দিতে চাচ্ছেন তাদের জেনে রাখা উচিত, দিনে গিয়ে দিনেই এই ঝরনা দেখে থানচি ফিরে আসাটা বেশ ক্লান্তিকর। তাই যাত্রায় বিরতি দিয়ে রেমাক্রিতে রাত্রিযাপন করাটা ভালো। একান্তই সময় স্বল্পতা থাকলে ভোর ৬টা বা ৭টার মধ্যে থানচি থেকে রওনা হতে হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-